গর্ভাবস্থায়-উচ্চ-রক্তচাপ-ঝুঁকি-ও-করণীয়

গর্ভাবস্থায়-উচ্চ-রক্তচাপ-ঝুঁকি-ও-করণীয়

প্রজনন ক্ষমবয়সের (১৫-৪৫ বছর) নারীদের প্রায় ৭.৭% উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। প্রায় ১০% গর্ভবতী নারী উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন।

গর্ভবতী নারীর রক্তচাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মা ও শিশু উভয়েরই স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গর্ভকালীন সিস্টোলিক চাপ ১৪০ মিমি পারদের সমান বা বেশি অথবা ডায়াস্টলিক রক্ত চাপ ৯০ মিলিমিটার-পারদের সমান বা বেশি হলে তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বলে। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ শুধু বাচ্চা পেটে আসার পর হয় এবং সাধারণত ২০ সপ্তাহ পর এ সমস্যা ধরা পড়ে। এতেও প্রস্রাবের সঙ্গে এ্যালবুমিন বের হয়ে যায় এবং বাচ্চা ডেলিভারির ৬ সপ্তাহ পর এ উচ্চ রক্তচাপ ভাল হয়ে যায়।

গর্ভকালীন সিস্টোলিক রক্তচাপ ১৪০ মিমি পারদের সমান বা বেশি অথবা ডায়াস্টলিক রক্তচাপ ৯০ মিলিমিটার-পারদের সমান বা বেশি হলে তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বলে।

গর্ভাবস্থার প্রথম ৫ মাসের মধ্যে রক্তচাপ বেড়ে গেলে সেই মায়ের আগে থেকেই খানিকটা উচ্চ রক্তচাপ ছিল বলে ধরে নেয়া যায়। যাঁদের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁরা সন্তান নেয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন। কিছু রক্ত চাপের ওষুধ গর্ভাবস্থায় খাওয়া যায় না। তাই প্রয়োজনে চিকিৎসক আগে থেকেই ওষুধ পরিবর্তন করে দিতে পারেন। সেই সঙ্গে রক্তচাপ পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে কিনা এবং উচ্চ রক্তচাপের কোন জটিলতা আছে কিনা, তা-ও পরীক্ষা করে নেয়া যাবে।

প্রি-এক্লামসিয়ারকারণ লক্ষণ ও চিকিৎসা একজন নারীর জীবনে সন্তান ধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পুরোপরি বার নতুন অতিথির আগমনী বার্তার অপেক্ষায় থাকে। সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে তাকে পৃথিবীর আলোতে মুখ দেখানো পর্যন্ত পুরো জার্নি-টা অনেক দুর্গম। একজন মাকে অনেক বিপদ পাড়ি দিতে হয়। তেমনি একটি বিপদের নাম প্রি-এক্লামসিয়া (চৎব-বপষধসঢ়ংরধ – চঊ) বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ। গর্ভাবস্থায় অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়। নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে না থাকলে অবস্থা জটিল হয়ে যেতে পারে। তাই আসুন আজ জেনে নেই গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।

গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ বা প্রি-এক্লামসিয়া কী? গর্ভাবস্থায় অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়। আবার অনেকের আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ থাকে, গর্ভাবস্থায় সেটি নিয়মিত হয়। প্রি-এক্লামসিয়া উচ্চ রক্তচাপজনিত একটি সমস্যা যা শুধুমাত্র গর্ভবতী মায়েদের হয়ে থাকে। শতকরা ৫-১৫ ভাগ নারী গর্ভাবস্থায় এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।

গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর যদি কারো উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে (এ সময় গর্ভবতী মহিলার রক্তচাপ

১৪০/৯০ মি.মি. অব মারকারির চেয়ে বেড়ে যায়) এবং ইউরিনের সঙ্গে প্রোটিন বা এলবুমিন যায়

তবে এই উপসর্গকে প্রি-এক্লামসিয়া বলা হয়।

গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণসমূহ : ১) উচ্চ রক্তচাপ (১৪০/৯০ মি.মি. বাতার বেশি)। রক্তচাপ ১৬০/১১০ মি. মি. বেশি হলে মারাত্মক। প্রি-এক্লামসিয়ার লক্ষণ। ২) হঠাৎ করে শরীরে পানি আসতে পারে বা শরীর ফুলে যেতে পারে।

৩) মাথাব্যথা বা ক্রমশ প্রচণ্ড মাথাব্যথা হওয়া এবং মাথার পেছনে বা সামনে প্রচণ্ড ব্যথা। ৪) চোখে ঝাপসা দেখা। ৫) উপরের পেটে প্রচণ্ড ব্যথা (ডান পাঁজরের নিচে)। ৬) মাথা ভারি লাগা বা ঝিমঝিম লাগা। ৭) প্রস্রাব কমে যাওয়া বা গাঢ় রঙের প্রস্রাব হওয়া।

প্রি-এক্লামসিয়ার কারণ : প্রি-এক্লামসিয়ার বিভিন্ন কারণ নিয়ে বিভিন্ন রকম মতদাব প্রচলিত আছে। তবে, সকল চিকিৎসা বিজ্ঞানী একমত যে, গর্ভকালের আগে থেকেই বা গর্ভকালীন সময়ে যাদের কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে, তাদের গর্ভকালীন সময়ে রক্তচাপ বেড়ে যাবার এবং প্রি-এক্লামসিয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। রক্তনালীর প্রদাহজনিত সমস্যার প্রভাব এর পেছনের রয়েছে।

কারা প্রি-এক্লামসিয়ার অতিরিক্ত ঝুঁকিতে আছেন?

১. যাদের পূর্বে একবারপ্রি-এক্লামসিয়া হয়েছে।

২. প্রি-এক্লামসিয়া পরিবারে কারও হলে।

৩. পরিবারে কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে।

৪. যাঁরা বেশি বয়সে মাহন তাদের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ৫. উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কিডনির সমস্যা আছে এমন রোগীদের।

৬. দুটো সন্তান প্রসবের মাঝে ১০ বছর বাতার বেশি ব্যবধান থাকলে। ৭. গর্ভবতী মায়ের অতিরিক্ত ওজন থাকলে।

চিকিৎসা

(১) প্রি-এক্লামসিয়া আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। (২) খাবারের সঙ্গে আলাদা লবণ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। (৩) প্রোটিন এবং ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেতে হবে।

(৪) পুষ্টিকর নরম খাবার খেতে হবে। (৫) রাতেগড়ে ৮ ঘণ্টা এবং দিনে ২ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।

(৬) পা ফুলে গেলে পা দুটো বালিশের উপর উঁচু করে রেখে ঘুমাতে হবে। (৭) ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ এবং প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে। (৮) রক্তচাপ, ওজনের চার্ট তৈরি করতে হবে। (৯) প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন যাচ্ছে কিনা তার চার্ট করতে হবে। (১০) বাচ্চার অবস্থাও বার বার দেখতে হবে। (১১) প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

বিবেচ্য বিষয়সমূহ

*সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে বিপদসমূহ মায়ের বিপদ, খিঁচুনি বা এক্লামসিয়া।

*মস্তিষ্কে উচ্চ রক্তচাপের জন্য রক্ত সরবরাহ কমে যায় যার ফলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি রেনাল ফেইলিওর-ও হতে পারে।

*জরায়ু থেকে পৃথক হয়ে যাবার ফলে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে মায়ের মৃত্যুও হতে পারে।

*গর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমে যাওয়া।

*সময়ের পূর্বে বাচ্চাপ্রসব।

*মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।

গর্ভস্থ শিশু মানবজাতকের বিপদ

কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ। অপরিণত শিশু। গর্ভের শিশু তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ উচ্চ রক্তচাপ থাকলে মায়ের প্লাসেন্টাতে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি ধীর হয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া। গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু।

প্রতিরোধ

১) যারা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাদের প্রথমেই সতর্ক হতে হবে। ২) গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত প্রসবপূর্ব চেকআপের ব্যবস্থা করতে হবে। ৩) গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা উচিত। ৪) নিয়মিত রক্তচাপ মাপা। ৫) প্রসাবে প্রোটিন যায় কিনা পরীক্ষা করা। ৬) রক্তশূন্যতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করা। ৭) হাতে-পায়ে পানি আছে কিনা ইত্যাদি পরীক্ষা করা।

গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ

আপনাকে যদি নিয়মিত রক্তচাপ কমানোর ওষুধ খেতে হয় এবং সে অবস্থায় আপনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন, তবে অবশ্যই আপনার ডাক্তারকে জানান। ডাক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী আপানার ওষুধ বদলে দেবেন। গর্ভবতী মায়েরা ওষুধ খেতে অনেক ভয়ে থাকেন যে ওষুধ গর্ভজাত সন্তানের ক্ষতি করবে কিনা। অতিরিক্ত ওষুধ আসলেই ক্ষতি করতে পারে কি? হ্যাঁ, করতে পারে। তবে চিকিৎসকগণ যেসব ওষুধ গর্ভাবস্থায় দেন, সেগুলো কোন বাচ্চার সমস্যা করে না। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে এমনএ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ দেয়া হয় যেগুলো বাচ্চার কোন সমস্যা করে না। হয়তো উচ্চ রক্তচাপের কারণে সমস্যা হবে, তবে ওষুধের কারণে সমস্যা হবে না।

করণীয়

১. নিয়মিত চেকআপ, প্রেগন্যান্সির সময়ে নিরাপদ ওষুধ এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তন সমর্কে জানতে

আগে থেকেই স্ত্রী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। ২. ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে কী খাবেন এবং কতটুকু পরিশ্রম করবেন জেনে নিন। প্রয়োজনে

পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হোন। ৩. খাবারে বাড়তি লবণ এড়িয়ে চলুন। ৪. দুশ্চিন্তা রক্তচাপ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত মেডিটেশন, যোগাসন বা হালকা ব্যায়াম আপনাকে এ থেকে মুক্তি দিতে পারে।

৫. বাসায় নিয়মিত প্রেশার মাপার ব্যবস্থা করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। আর তা না হলেও নিয়ম

মেনে রক্তচাপের ওঠানামা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তবেই সুস্থ থাকবেন গর্ভবতী মা, আর জন্ম দেবেন সুস্থ শিশু।

গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ

আপনাকে যদি নিয়মিত রক্তচাপ কমানোর ওষুধ খেতে হয় এবং সে অবস্থায় আপনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন, তবে অবশ্যই আপনার ডাক্তারকে জানান। ডাক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী আপানার ওষুধ বদলে দেবেন। গর্ভবতী মায়েরা ওষুধ খেতে অনেক ভয়ে থাকেন যে ওষুধ গর্ভজাত সন্তানের ক্ষতি করবে কিনা। অতিরিক্ত ওষুধ আসলেই ক্ষতি করতে পারে কি? হ্যাঁ, করতে পারে। তবে চিকিৎসকগণ যেসব ওষুধ গর্ভাবস্থায় দেন, সেগুলো কোন বাচ্চার সমস্যা করে না। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে এমন এ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ দেয়া হয় যেগুলো বাচ্চার কোন সমস্যা করে না। হয়তো উচ্চ রক্তচাপের কারণে সমস্যা হবে, তবে ওষুধের কারণে সমস্যা হবে না।

ডাঃ শাহজাদা সেলিম

সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

ফোন : ০১৯১৯০০০০২২

প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারী ২০২০; দৈনিক জনকণ্ঠ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *